২০২৫ সালের অক্টোবর শেষে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভালো ব্যাংকগুলো নতুন আমানত আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও দুর্বলগুলো এখনো তারল্য সংকটে ভুগছে। পাচ্ছে না নতুন আমানত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১৭ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং আগস্টে ১০ শতাংশের বেশি। তবে জুলাই ২০২৫-এর ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ডিসেম্বর ২০২৪-এর ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশের তুলনায় এটি অনেক ভালো।
ব্যাংকাররা বলছেন, পুনরুদ্ধার এখনো অসম। সুশাসিত ও তারল্যসমৃদ্ধ ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের আস্থা পাচ্ছে, কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলোতে আস্থার সংকট রয়ে গেছে।
সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক নিয়মিত ভালো আমানত পেয়েছে। বিপরীতে, সংকটে থাকা পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, যেগুলো বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনর্গঠন কাঠামোর আওতায় রয়েছে, তারা চাপের মুখে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অগাস্টে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণচাহিদা কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এই অব্যবহৃত অর্থ জমেছে। ঋণ বিতরণের সুযোগ সীমিত হওয়ায় এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনমনে ব্যাংক খাতের আতঙ্ক চরমে পৌঁছায়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে ব্যাপক অর্থ উত্তোলন হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে এবং পরে একীভূতকরণ শুরু করে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ এখনো আমানতভিত্তি শক্ত করতে বড় ভূমিকা রাখছে। অধিকাংশ রেমিট্যান্স শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করছে। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার মাস শেষে কোনো সঞ্চয় রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এটি ইঙ্গিত দেয়, পরিবারগুলো ধীরে ধীরে অব্যবহৃত অর্থ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনছে।
অক্টোবরে মোট আমানতের মধ্যে ১৭ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা ছিল মেয়াদি আমানত এবং ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা ছিল চাহিবামাত্র আমানত। তার মানে, মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম স্থায়ী সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতে এই সামান্য পুনরুদ্ধার ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করার ওপর।
ব্যাংক খাত এখনো উচ্চ খেলাপি ঋণ, দুর্বল ঋণ যাচাই এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করছে। এ বছর খেলাপি ঋণ হঠাৎ বেড়ে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক সংস্কার চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ বিতরণে কঠোর নজরদারি, দ্রুত ব্যাংক একীভূতকরণ, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং দুর্বল ব্যাংকে বিদেশ ভ্রমণ, বোনাস ও নতুন ঋণ সীমিত করার নিয়ম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব পদক্ষেপ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। এদিকে, ঋণ বিতরণও বেড়েছে। অক্টোবর মাসে ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ২১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানত আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কয়েকটি কাঠামোগত কারণ রয়েছে। প্রথমত, এসব ব্যাংকের শাসনব্যবস্থা দুর্বল এবং ঋণ যাচাই প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। ফলে খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, যা আমানতকারীদের আস্থায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবিত ঋণ বিতরণ ও স্বজনপ্রীতি ব্যাংক পরিচালনায় দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। এতে সাধারণ মানুষ মনে করে তাদের অর্থ নিরাপদ নয়।
তৃতীয়ত, দুর্বল ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট স্থায়ী হয়ে উঠেছে। যখন শক্তিশালী ব্যাংকগুলো নিয়মিত রেমিট্যান্স ও কর্পোরেট আমানত পাচ্ছে, তখন সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখার প্রবণতা কমছে। আমানতকারীরা নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা খুঁজে পান সুশাসিত ব্যাংকে, যেখানে ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
চতুর্থত, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যেমন বিদেশ ভ্রমণ, বোনাস ও নতুন ঋণ সীমিতকরণ। এসব পদক্ষেপ আমানতকারীদের কাছে সংকেত দিচ্ছে যে, ব্যাংকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতকারীরা এখন বেশি আগ্রহী মেয়াদি আমানতে, যা মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলোতে এই সুযোগও সীমিত। ফলে আস্থা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এসব ব্যাংক নতুন আমানত পাবে না। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছ ঋণ যাচাই এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংক পরিচালনা করতে হবে।





