জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভোজ্যতেল আমদানিতে নতুন কর সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কায় দ্বিধায় রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে ভোজ্যতেলের ওপর কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে, যা বর্তমানে এনবিআরের পর্যালোচনায় রয়েছে।
এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, কর ছাড় দেওয়া এখন জটিল হয়ে পড়েছে। কারণ কর ব্যয় নীতিমালা এনবিআরের ক্ষমতা সীমিত করেছে। তিনি বলেন, “কর ছাড়ের বিষয়টি হয় উপদেষ্টা পরিষদ অথবা নির্বাচিত সরকারের সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে।”
এনবিআরের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ভোজ্যতেলে কর ছাড় দিলে সরকার প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। গত বছর এনবিআর ভোজ্যতেল আমদানিতে কর সুবিধা দিয়েছিল, যা ৩০ জুন ২০২৫-এ শেষ হয়।
সরকার বর্তমানে আমদানির পর্যায়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট, স্থানীয় উৎপাদনে ৬০০ কোটি টাকা ভ্যাট এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে ১০ কোটি টাকা ভ্যাট সংগ্রহ করে।
ভ্যাট কর্মকর্তারা বি ২৪ নিউজকে জানিয়েছেন, এনবিআর এখন পর্যন্ত কর ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে সরকার যদি রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে নির্দেশ দেয়, তাহলে ব্যবসায়িক ও স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে কিছু কর সুবিধা বিবেচনা করা হতে পারে। কর্মকর্তা আরও বলেন, স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে দুই থেকে তিন মাসের জন্য কর ছাড় দিলে প্রায় ৭০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে।
টিকে গ্রুপের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সীমিত সময়ের জন্য কর ছাড় শিল্পের জন্য সহায়ক নয়, বরং আরও জটিলতা তৈরি করে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করেছি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে। এখন যদি সরকার কর ছাড় দেয়, তাহলে কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে সঙ্গে দাম কমাতে বাধ্য হতে হবে।”
তিনি যোগ করেন, শুধু করই সমস্যা নয়; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও কাঁচামাল আমদানির মতো বিষয়গুলোও ভোজ্যতেলের দামে প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির সভাপতি এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, কর কমালে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে রমজানে দাম কমতে পারে, কারণ নতুন ভোজ্যতেল আমদানি করতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগে।
সম্প্রতি ভোজ্যতেল নিয়ে আলোচনায় আসে, যখন বাণিজ্য উপদেষ্টা অভিযোগ করেন যে ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই দাম বাড়িয়েছে। পরে ট্যারিফ কমিশন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৫ টাকা নির্ধারণ করে।
ভোজ্যতেল আমদানিতে কর সুবিধা জুন ২০২৫-এ শেষ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে করছাড় একটি দ্বিমুখী নীতি। একদিকে এটি ভোক্তা ও বাজারকে স্বস্তি দেয়, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব কাঠামোতে চাপ সৃষ্টি করে।
সুবিধা: করছাড় দিলে আমদানি পণ্যের দাম কমে যায়, ফলে সাধারণ ভোক্তা বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বস্তি পায়। রমজানের মতো মৌসুমে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কর ছাড় কার্যকর হতে পারে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে, ব্যবসায়ীরা দ্রুত পণ্য সরবরাহে উৎসাহিত হয় এবং ভোক্তা আস্থা বৃদ্ধি পায়। স্বল্পমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও করছাড় সহায়ক হতে পারে।
অসুবিধা: তবে অর্থনীতিবিদরা বলেন, করছাড় দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি করে। সরকারের সামাজিক খাত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কমে যায়। কর ছাড় শিল্পে স্থায়ী সমাধান দেয় না, বরং ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিকভাবে দাম কমালেও উৎপাদন ব্যয় (গ্যাস, বিদ্যুৎ, কাঁচামাল) অপরিবর্তিত থাকায় টেকসই প্রভাব পড়ে না। এছাড়া কর ছাড়ের সুযোগে কিছু প্রতিষ্ঠান বাজারে কারসাজি করতে পারে, যা ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর।
অর্থনীতিবিদদের মতে, করছাড়কে স্বল্পমেয়াদি নীতি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত বিশেষ পরিস্থিতি যেমন রমজান বা হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে বাজার নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা, উৎপাদন খরচ কমানো এবং দক্ষ নীতি প্রয়োগই বেশি কার্যকর।





