ব্যাংকে রাখা টাকা নিয়ে মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসা-এটি নিরাপদ। চাকরিজীবীর মাসের বেতন, প্রবাসীর রেমিট্যান্স, ব্যবসায়ীর চলতি মূলধন কিংবা অবসরকালীন সঞ্চয়, সবই শেষ পর্যন্ত গিয়ে জমা হয় ব্যাংকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের যে বিস্ফোরক উত্থান দেখা যাচ্ছে, তাতে এই নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্নটি এখন আর তাত্ত্বিক নয়; এটি বাস্তব ও সময়ের দাবি, খেলাপি ঋণ বাড়লে সাধারণ আমানতকারীর টাকা কতটা নিরাপদ থাকে?
সংখ্যাই বলে দিচ্ছে সংকট কতটা গভীর
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এটি দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৫ থেকে ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যে প্রতি ১০০ টাকা ঋণ দিয়েছে, তার প্রায় ৩৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত।
এ সংখ্যাটি শুধু বড় নয়, ভয়াবহও। কারণ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০২৫ সালের মার্চেই তা ছাড়িয়ে যায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এরপর মাত্র ছয় মাসে আরও দুই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপির খাতায় যোগ হয়। এই গতি স্বাভাবিক নয়। এটি স্পষ্টতই ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতার প্রকাশ।
কোন ব্যাংকগুলো বেশি ঝুঁকিতে
খেলাপি ঋণের বোঝা সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে সমান নয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দেওয়া প্রায় অর্ধেক ঋণই এখন অনাদায়ী বা ঝুঁকিপূর্ণ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুব স্বস্তিদায়ক নয়। সামগ্রিকভাবে বেসরকারি ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ২০ শতাংশের বেশি। এর ভেতরে কিছু ব্যাংকে এই হার ৩০-৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, এমনকি কোথাও কোথাও ৮০-৯০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
তুলনামূলকভাবে বিদেশি ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো। সেখানে খেলাপি ঋণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে। এটি প্রমাণ করে-সমস্যাটি অর্থনীতির বাইরের কোনো অদৃশ্য দুর্যোগ নয়; বরং ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও জবাবদিহির ঘাটতির ফল।
খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের ভেতরে কী ঘটে
খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রভাব প্রথমে দেখা যায় ব্যাংকের আয় ও মুনাফায়। ঋণের সুদ আসে না, অথচ আমানতের ওপর সুদ দিতে হয় নিয়মিত। ফলে ব্যাংককে তার নিজস্ব মূলধন থেকে ঘাটতি মেটাতে হয়। এতে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এরপর দেখা দেয় তারল্য সংকট। ব্যাংকের হাতে নগদ অর্থের চাপ তৈরি হয়। বড় অঙ্কের টাকা তুলতে গেলে নানা অজুহাতে সময় নেওয়া হয়। কখনো কখনো অঘোষিত সীমাবদ্ধতাও আরোপ করা হয়। নতুন ঋণ দেওয়া কমে যায়, ফলে ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্থবিরতা আসে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ব্যাংক তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যাকে সাধারণ ভাষায় বলা যায় ‘লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যাংক’।
আমানতকারীর টাকা কোথায় ঝুঁকিতে পড়ে
এখানে একটি মৌলিক সত্য মনে রাখা জরুরি, ব্যাংক নিজের টাকা দিয়ে ঋণ দেয় না। ব্যাংক ঋণ দেয় আমানতকারীর টাকা থেকেই। অর্থাৎ ঋণ খেলাপি হলে ক্ষতির ঝুঁকিও শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে আমানতকারীর ওপর।
বাংলাদেশে আমানত বিমা ব্যবস্থা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সীমা খুবই কম। বড় অঙ্কের আমানতকারীর ক্ষেত্রে এই বিমা কার্যত কোনো সুরক্ষা দেয় না। ফলে কোনো ব্যাংক বড় সংকটে পড়লে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় পড়ে যান।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বড় পরিসরে আমানত হারানোর ঘটনা ঘটেনি, এটি সত্য। কিন্তু অতীতে কিছু দুর্বল ব্যাংকে টাকা তুলতে সীমাবদ্ধতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কিংবা একীভূতকরণের নজির আছে। এগুলো ইঙ্গিত দেয়, ঝুঁকি কেবল তাত্ত্বিক নয়।
কেন খেলাপি ঋণ কমছে না
খেলাপি ঋণের জন্য শুধু ঋণগ্রহীতাদের দায়ী করলে সমস্যার পুরো চিত্র পাওয়া যায় না। এখানে দায় রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা পর্ষদ এবং নীতিনির্ধারকদেরও।
বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর চাপে যথাযথ যাচাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরপর বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেও কেউ কেউ পুনঃতফসিল, ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধা পেয়ে গেছেন। এতে নিয়ম মেনে ঋণ পরিশোধ করা গ্রাহকদের জন্য বার্তাটি হয়েছে নেতিবাচক, ঋণ না দিলেও চলে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা ও শিথিল তদারকিও এই সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
আন্তর্জাতিক তুলনায় বাংলাদেশ কোথায়
এক দশক আগেও বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার ছিল এক অঙ্কে বা তার কাছাকাছি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় তখন পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে যখন খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তখন এটি স্পষ্টভাবে একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতির লক্ষণ। ব্যাংকিং খাত দুর্বল হলে বিনিয়োগ কমে, কর্মসংস্থান ব্যাহত হয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও চাপের মুখে পড়ে।
আমানতকারীর করণীয় কী
এই পরিস্থিতিতে আমানতকারীর জন্য সবচেয়ে বড় করণীয় হলো সচেতনতা। সব সঞ্চয় এক ব্যাংকে না রেখে একাধিক ব্যাংকে ভাগ করে রাখা ঝুঁকি কমাতে পারে। অস্বাভাবিক উচ্চ সুদের প্রলোভনে পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন, খেলাপি ঋণের হার এবং সামগ্রিক সুনাম সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন।
খেলাপি ঋণ এখন আর কেবল ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; এটি সাধারণ মানুষের আমানত ও অর্থনীতির আস্থার প্রশ্ন। বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।
পুনঃতফসিল ও বিশেষ সুবিধার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও স্বাধীনতা জোরদার করতে হবে। না হলে খেলাপি ঋণের চাপ একসময় এমন জায়গায় পৌঁছাবে, যেখানে আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।
ব্যাংকে রাখা আমানত এখনই পুরোপুরি অনিরাপদ, এমন কথা বলা যাবে না। কিন্তু খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি যে এই নিরাপত্তার ভিত্তিকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
খেলাপি ঋণকে যদি কেবল সংখ্যার হিসাব হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ভুল হবে। এটি আসলে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়, আস্থা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই প্রশ্নের উত্তর একদিন আমাদের সবার জন্যই অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
