B24NEWS

ঢাকার হাতিরঝিলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘রান ফর দ্য আর্থ’


পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারার গুরুত্ব তুলে ধরতে আগামীকাল ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার হাতিরঝিলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘রান ফর দ্য আর্থ ২০২৫’। দি অ্যাথলিট এক্স-এর আয়োজনে এই পরিবেশবান্ধব দৌড় আয়োজনকে ঘিরে অংশ নিচ্ছেন দেশজুড়ে দুই হাজারের বেশি দৌড়বিদ ও পরিবেশসচেতন মানুষ।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুস্থ জীবনযাপনের আহ্বান নতুন কিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরদূষণ, অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা-এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই নানা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো, এসব উদ্যোগ কতটা প্রতীকী, আর কতটা বাস্তব পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার হাতিরঝিলে আয়োজিত হতে যাওয়া ‘রান ফর দ্য আর্থ ২০২৫’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে সামনে আসে। একদিকে এটি একটি দৌড় প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে পরিবেশ ও টেকসই জীবনধারাকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। এই উদ্যোগ আমাদের ভাবতে বাধ্য করে- এ ধরনের আয়োজন কেন প্রয়োজন, কীভাবে তা কাজ করে এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে।

বাংলাদেশের শহরগুলো দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত চাপের মধ্যে রয়েছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং খোলা জায়গার অভাব নাগরিক জীবনের নিত্যসঙ্গী। একই সঙ্গে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, মানসিক চাপ ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। এই দুটি সংকট পরিবেশ ও স্বাস্থ্য আসলে পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। টেকসই নগরায়ণ ও সুস্থ জীবনযাপনকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। ‘রান ফর দ্য আর্থ’-এর মতো আয়োজন এই সংযোগটিকেই সামনে আনে এবং নাগরিকদের মনে করিয়ে দেয়, ব্যক্তিগত অভ্যাস ও সামষ্টিক পরিবেশ একে অন্যকে প্রভাবিত করে।

কেন দৌড়, কেন প্রতীকী আয়োজন?

প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি ম্যারাথন কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করবে। বাস্তবতা হলো, একটি দৌড় নিজে থেকে দূষণ কমাতে পারে না। কিন্তু এটি সচেতনতা তৈরি করতে পারে, আলোচনার জায়গা খুলে দিতে পারে। ইতিহাস বলছে, সামাজিক পরিবর্তনের অনেক সূচনা হয়েছে প্রতীকী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে, যা ধীরে ধীরে নীতিগত ও আচরণগত পরিবর্তনে রূপ নিয়েছে। দৌড় একটি সহজ, অংশগ্রহণমূলক ও দৃশ্যমান কার্যক্রম। এতে তরুণ, পরিবার, ফিটনেস কমিউনিটি , বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যুক্ত হতে পারেন। এই বহুমাত্রিক অংশগ্রহণই বার্তাটিকে বড় পরিসরে পৌঁছে দেয়।

এই উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আয়োজনের ভেতরেই পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্তগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা। পুনর্ব্যবহারযোগ্য জার্সি, প্লাস্টিকের বদলে কাগজের কাপ, ডিজিটাল বোর্ড ব্যবহার এসব পদক্ষেপ হয়তো সামগ্রিক পরিবেশ সংকটের তুলনায় ছোট। কিন্তু এগুলো দেখায় যে টেকসইতা শুধু বক্তব্যে নয়, বাস্তব ব্যবস্থাপনায়ও প্রয়োগ করা সম্ভব। বাংলাদেশে বড় আকারের ইভেন্ট মানেই অতিরিক্ত বর্জ্য ও অপ্রয়োজনীয় প্রদর্শন, এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার দিক থেকেও বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।

এ ধরনের আয়োজনের ক্ষেত্রে করপোরেট সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এটি কি কেবল ব্র্যান্ড প্রচারের কৌশল, নাকি প্রকৃত দায়বদ্ধতার প্রকাশ? উত্তর একমাত্রিক নয়। করপোরেট খাত দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশগত সমস্যার অংশ হিসেবে সমালোচিত। তবে একই সঙ্গে তাদের সম্পদ, সংগঠন ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। যদি এই ক্ষমতা দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে তা ইতিবাচক পরিবর্তনের অনুঘটক হতে পারে। ‘রান ফর দ্য আর্থ’-এর বার্তাটি এখানে স্পষ্ট-কর্মীদের সুস্থতা, কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ এবং পরিবেশগত দায় একসঙ্গে বিবেচনা করা সম্ভব। প্রশ্ন হলো, এই বার্তা কি আয়োজনের দিনেই শেষ হবে, নাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি নীতিতে প্রতিফলিত হবে।

সামাজিক আন্দোলন নাকি একদিনের উৎসব?

আমি মনে করি, আয়োজকেরা এটিকে একটি “সম্মিলিত আন্দোলন” হিসেবে দেখতে চান। আন্দোলন তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা ধারাবাহিকতা পায়। একটি দিনের দৌড় যদি অংশগ্রহণকারীদের দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা দেয়- যেমন হাঁটা বা সাইকেল ব্যবহার, প্লাস্টিক কমানো, পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়া, তবেই এর সামাজিক মূল্য তৈরি হবে। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের উদ্যোগকে কেবল ইভেন্ট হিসেবে নয়, বৃহত্তর নাগরিক সচেতনতার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু অভিযোজনের কথা বললেও নগর পর্যায়ে বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়ে গেছে। খোলা জায়গা সংরক্ষণ, হাঁটাবান্ধব অবকাঠামো, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নাগরিক উদ্যোগ রাষ্ট্রকে বিকল্প দিতে পারে না, তবে চাপ ও দিকনির্দেশনা দিতে পারে। ‘রান ফর দ্য আর্থ’-এর মতো আয়োজন নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দেয় যে জনগণের একটি অংশ স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব নগর চায়।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়, সবুজ বার্তা কি প্রতীকেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা অভ্যাস ও নীতিতে রূপ নেবে? ‘রান ফর দ্য আর্থ ২০২৫’ একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় যে, সচেতনতার জায়গা তৈরি করা সম্ভব। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে আয়োজনের পর কী ঘটে তার ওপর। করপোরেট খাত কি তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে টেকসই নীতি জোরদার করবে? অংশগ্রহণকারীরা কি নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনবেন? আর রাষ্ট্র কি নাগরিক উদ্যোগকে সহায়ক নীতিতে রূপ দেবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে, এটি একটি স্মরণীয় দৌড় হয়ে থাকবে, নাকি পরিবেশ ও সুস্থ জীবনধারার পথে একটি বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা নেবে।

লেখক:  ব্যাংকার

Exit mobile version